সোশ্যাল মিডিয়ায়, নিজে মুখেই বলে বেড়িয়েছিলেন নিজের প্রতারণার গল্প। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতারণা, তাও আবার গর্বের সঙ্গে। যদিও পরে, প্রতারক ভারতীয় ছাত্রের এই গর্ব, তাঁকে জেলের গরাদ পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল। মূলত, মিথ্যে গল্প তৈরি করে আমেরিকায় ভর্তির আবেদন করেছিলেন ১৯ বছর বয়সী এক ভারতীয় ছাত্র। মেধাবী না হয়েও ফুল স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য বাবার মৃত্যুর ভুয়ো খবর ছড়িয়ে দিতেও দু'বার ভাবেননি। একটি রেডিট পোস্টের মাধ্যমে সব তথ্য ফাঁস হয়ে গিয়েছে।
জানা গিয়েছে, ভারতীয় এই ছাত্রের নাম আরিয়ান আনন্দ। তিনি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট রেডিটে 'আমি মিথ্যার উপর আমার জীবন এবং ক্যারিয়ার তৈরি করেছি' শিরোনামে একটি পোস্ট করেছিলেন। পরে একজন রেডিও মডারেটর তাঁর পোস্টটি পড়ে, ছাত্রটিকে খুঁজে বের করেছিলেন। এরপর ওই মডারেটর ছাত্রের বিশ্ববিদ্যালয়কে এই ভুয়ো কাজ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। আমেরিকার, লেহাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন তিনি। এরপর বিশ্ববিদ্যালয়টি, সবটা শুনে হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। এবং অবশ্যই ওই ছাত্রের বিরুদ্ধে এখন বড়সড় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ঠিক কী কী লিখেছিলেন ওই ছাত্র
একটি বেনামী রেডডিট পোস্টে, নিজের কুখ্যাত মিথ্যাচার নিয়ে বড়াই করে, আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন যে কীভাবে তিনি দ্বাদশ শ্রেণির বোর্ডের ডিগ্রি, তাঁর স্কুলের অধ্যক্ষের ইমেল ঠিকানা এবং আমেরিকায় পড়ার জন্য বাবার মৃত্যুর সার্টিফিকেট জাল করেছিলেন। তাঁর গল্প শুরু হয়েছিল দশম শ্রেণিতে। বোর্ড পরীক্ষা বাতিলের সময়। 'সেদিন থেকে এখনও পর্যন্ত, আমি দু'ঘণ্টাও সিরিয়াসলি পড়াশোনা করিনি,' তিনি লিখেছিলেন। আনন্দ বলেছিলেন যে তিনি একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বেছে নিয়েও, পড়াশোনায় আগ্রহ দেখাননি। যদিও একাদশ পাস করার পরে, তিনি দ্বাদশ শ্রেণিতে সিরিয়াস হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাও দুই বা তিন দিনের বেশি নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে ছাত্রের দাবি, 'আমার জীবনে একটা সময় ছিল যখন আমি শুধু খেতাম, ঘুমাতাম এবং সিনেমা দেখতাম।
আরও পড়ুন: (TISS Job Cut Latest Update: 'টাকা দেবে টাটা ট্রাস্ট', প্রত্যাহার করা হল TISS-এর গণ ছাঁটাইয়ের নোটিশ)
এরপর যখন কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় এসেছিল, তখনই শুরু হয়েছিল ছাত্রের আসল স্ক্যাম। বুঝেছিলেন যে মার্কস দিয়ে তিনি কখনওই কোনও ভারতীয় কলেজে ভর্তি হতে পারবেন না। তাই আনন্দ একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য খুব ভেবে চিন্তে জালিয়াতি প্ল্যান করেছিলেন। প্রথমে স্কুলের অধ্যক্ষের জাল স্ট্যাম্প ও সিল তৈরি করে শিক্ষাগত নথিও জাল করেছিলেন। তারপর, নিজের স্কুলের নামের অনুরূপ একটি ওয়েবসাইটের ডোমেইন কিনে স্কুল এবং এর প্রিন্সিপালের জাল ইমেল ঠিকানা তৈরি করেছিলেন। বিদেশে কলেজে ভর্তির প্রবন্ধ লেখার জন্য আবার চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেছিলেন। এইভাবেই আমেরিকার বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেছিলেন ছাত্র। সফল হয়েছিল স্ক্যাম। আমেরিকার সেরা ২৫ কলেজের একটিতে সুযোগ পেয়ে গিয়েছিলেন। চায়রের কথায়, 'আমাকে একটি খুব ভাল আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল, যা আমার খাবার খরচ ছাড়া প্রায় সবকিছুই কভার করে।
খাবার খরচ তুলতে বাবার মৃত্যুর ভুয়ো রটনা
আনন্দ বলেছিলেন যে তাঁর খাবারের খরচেও বার্ষিক ৫ থেকে ৬ লক্ষ খরচ হত। যদিও, বাবা-মা এত টাকা দিতে পারতেন, কিন্তু তবুও তিনি কিছুই নিতে চাননি। সবটাই বিনামূল্যে করতে চেয়েছিলেন। তারপরে তিনি এমন কিছু করেছিলেন যা নিজের চোখেই খুব ভুল বলে মনে হয়েছিল। বলেছিলেন, আমি আমার বাবার একটি সম্পূর্ণ জাল ডেথ সার্টিফিকেট তৈরি করে, আমার কলেজে পাঠিয়েছিলাম, বলেছিলাম যে আমার বাবা ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। ছাত্রের এই মেসেজ পেয়ে তাঁর লেহাই ইউনিভার্সিটি তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর আর্থিক সাহায্য প্যাকেজ বাড়িয়ে দিয়েছিল। নিজের পকেট থেকে এক পয়সা খরচ না করেই আমেরিকায় পৌঁছে গিয়েছিলেন আনন্দ। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েও, পরীক্ষা পাস করার জন্য চ্যাটজিপিটির অপ ব্যবহার করতে ভোলেননি।
আরও পড়ুন: (NEET Re-Test Result of 1563 candidates out: নিট পরীক্ষায় গ্রেস মার্কস পাওয়া ১৫৬৩ পড়ুয়ার রি-টেস্টের ফল প্রকাশ করল NTA)
নিজের পোস্টে, নিজের পরীক্ষায় প্রতারণা করার জন্য কীভাবে এআই ব্যবহার করেছিলেন। তাও বলেছেন গুছিয়ে। এমনকি একটি জাল সিভি দিয়ে ইন্টার্নশিপও করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে আনন্দ বলেছিলেন, আমি নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক একটি ছোট বীমা ফার্মে মার্কেটিং ইন্টার্ন পদ পেয়েছি। এটি রিমোট জব, আমাকে যা করতে হবে তা হল কিছু ইমেল পাঠানো এবং মাঝে মাঝে কিছু ফোন কল করা। এটা পার্টটাইম। আমি এটি দিনে ২-৩ ঘণ্টার মতো করি, এবং বেশিরভাগ সময়, সিনেমা দেখি বা কিছু করি, যদি না আমার জন্য কিছু নির্ধারিত থাকে। এইভাবেই আমি মাসে প্রায় ১৫০০ মার্কিন ডলার, প্রায় ১,২ লক্ষ টাকা করে উপার্জন করি। এরপর শুধুমাত্র নিজের বন্ধুদের সঙ্গে মদ্যপান এবং পার্টি করার জন্য ভারতে ফিরে এসেছিলেন আনন্দ।
নিজের প্রতারণামূলক কাজ নিয়ে গর্বিত আনন্দ
আনন্দ লিখেছিলেন, তিনি যা আয় করেন, তা ব্যয় করতে পছন্দ করেন না। শুধুমাত্র জল খেতে, ইলেকট্রনিক জিনিসপত্র কেনার পিছনেই টাকা ঢালেন। এর বেশি কিছু করেন না। কারণ, প্রতারণা ছাড়া আর অন্য কিছুতে নিজের ব্রেনকে ব্যবহার করতে চান না আনন্দ।
শেষ পরিণতি করুণ
এই পুরো পোস্টটি দেখে প্রায় চমকে গিয়েছিলেন, এক মডারেটর। সরাসরি সতর্ক করেছিলেন লেহাই বিশ্ববিদ্যালয়কে। তারপরেই ধ্বংস হয়েছিল আনন্দে জাল রাজত্ব। যদিও আনন্দকে, জালিয়াতির জন্য ১০ থেকে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হতে পারত, পারে, কিন্তু তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় একটি চুক্তি অনুযায়ী তা করেনি। সূত্রের খবর অনুযায়ী, ছেলেটির সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যেই সমঝোতা করা হয়েছিল। এর অধীনে, আরিয়ান আনন্দ ভারতে ফিরে আসতে রাজি হয়েছিলেন। লেহাই ইউনিভার্সিটি তাঁর থেকে ৮৫,০০০ মার্কিন ডলার (প্রায় ৭০ লক্ষ টাকা) ক্ষতিপূরণ আদায় না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ছাত্রের এই ভয়ানক মিথ্যাচার এবং রেকর্ডের সঙ্গে টেম্পারিংয়ের অভিযোগও তুলে নেওয়া হয়েছিল।