HT Bangla Special:ঘরে, বাইরে দুই ক্ষেত্রেই মহিলারা এখন এগিয়ে চলেছেন যুগের সঙ্গে। কিন্তু একই সঙ্গে বাস্তবিক নানা সমস্যার সম্মুখীনও হতে হচ্ছে তাঁদের। কর্পোরেট অফিসের কর্মীই হোন বা সরকারি দফতর, বহু মহিলাই বর্তমানে কর্মক্ষেত্রজনিত উদ্বেগ বা ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটির শিকার। অফিস আওয়ার্সের মধ্যে ঘটে চলা নানা ঘটন-অঘটন মনের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। প্রভাব ফেলে জীবনেও। কতটা গুরুতর এই সমস্যা? আর সমাধানই বা কীসে? আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষেহিন্দুস্তান টাইমস বাংলার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বললেনমনোবিদ সোহিনী সাহা (কনসালটেন্ট সাইকোলজিস্ট, মেডিকা সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল)।
একেকটি কর্মক্ষেত্রে একেকধরনের স্ট্রেস
‘ওয়ার্কিং উম্যান বলতেই এই ব্র্যাকেটের মধ্যে কর্মরত এমন সব মহিলাই পড়ছেন। তিনি চা বাগান, কলকারখানার মহিলা শ্রমিক, বাড়ির পরিচারিকাও হতে পারেন। আবার আইটি সেক্টর বা সরকারি দফতরে কর্মরতা নারীও হতে পারেন।’ সোহিনীর কথায়, ‘একেকটি কর্মক্ষেত্রে, একেকটি আর্থসামাজিক (সোশিও-ইকোনমিক) পরিবেশ অনুযায়ী একেকরকমের স্ট্রেস ও অ্যাংজাইটির শিকার হয়ে থাকেন মহিলারা। প্রথমে যে যে ধরনের স্ট্রেস প্রায় সবরকম কর্মক্ষেত্রেই দেখা যায়, সেগুলি নিয়ে আলোচনা করা যাক।’
কর্মক্ষেত্রে যে যে সমস্যার শিকার মহিলারা
কর্মক্ষেত্রে মূলত যে যে সমস্যার শিকার হন মহিলারা, সেই বিষয়গুলি নিয়ে প্রথমে আলোচনা করলেন সোহিনী—
১. লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য - বর্তমান সময়ে কর্মক্ষেত্রে খুব বেশি দেখা যাচ্ছে যে জিনিসটি তা হল লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য। অনেকসময় দেখা যায়, প্রচুর পরিমাণে কাজ চাপানো হচ্ছে একজনের উপর, এটা যেমন একটা সমস্যার দিক। তেমনই আবার দেখা যাচ্ছে, একজন যোগ্য হলেও শুধুমাত্র মহিলা বলে তাঁকে গুরুতর দায়িত্বগুলো দেওয়া হচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে এগুলি হতে থাকলে স্বাভাবিকভাবে একজনের স্ট্রেসড লাগবে, কাজে যেতে ইচ্ছে করবে না।
২. কাজের চাপ, পদোন্নতি, বেতন নিয়ে বৈষম্য -পরিসংখ্যান বলছে, মহিলাদের বেশি খাটিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বহু সংস্থাতেই রয়েছে। সেক্ষত্রে কাজের চাপ বাড়িয়ে দেওয়া হয় অত্যাধিক। কিন্তু সেই তুলনায় বেতন দেওয়া হয় না। একজন পুরুষকর্মী যতটা বেতন পান, ততটা বেতন পান না একজন মহিলাকর্মী। আবার, পদোন্নতি বা বেতনবৃদ্ধির সময়েও একই সমস্যার শিকার হতে হয় বহু মহিলাকে। বৈষম্যমূলক এই আচরণের জেরে উদ্বেগের শিকার হওয়া, মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন অনেকে।

অস্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ - কর্মক্ষেত্রে বেতন, পদোন্নতির বৈষম্য নানারকম কুপ্রস্তাব ও নিগ্রহেরও শিকার হতে হয় মহিলাদের। কর্মক্ষেত্রের আর্থসামাজিক পরিবেশ অনুযায়ী এই সমস্যা বাড়ে বা কমে। ফলে সব কিছু মিলিয়েই কাজের পরিবেশ হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর। যেখানে দীর্ঘদিন কাজ করতে করতে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হয়।
দশভুজা হতে গিয়ে…
শুধু যে কর্মক্ষেত্র থেকেই ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটি তৈরি হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। মনোবিদ সোহিনীর কথায়, ‘ওয়ার্কিও উম্যান না হলেও মহিলাদের অনেকরকম ভূমিকা পালন করতে হয় রোজকার জীবনে। অফিসে যেমন একজন কর্মীর ভূমিকা, তেমনই বাড়িতে কখনও গৃহিণীর ভূমিকা, কখনও স্ত্রী, কখনও মা, কখনও মেয়ের দায়িত্বও পালন করতে হয় এক মহিলাকে। এতরকম ভূমিকা পালন করতে গিয়ে অনেক মহিলাই একটা সময়ের পর পেরে ওঠেন না। আমরাস্ট্রাগল টু জাগল বলি এই সমস্যাকে। অনেকেই মনে করেন, আমাকে এটাও পারতে হবে, ওটাও পারতে হবে। অর্থাৎ দশভুজা হওয়ার একটা দায় থাকে। কেউ কেউ নিজে থেকেই কাঁধে দায়টি নেন। কিন্তু মনে রাখা জরুরি, আমরা প্রত্যেকেই মানুষ। তাই মানুষের সামর্থ্য অনুযায়ীই কাজ করতে হবে।’
বাড়ি থেকে পর্যাপ্ত সাপোর্ট না পেলে
ওয়ার্ক রিলেটেড স্ট্রেস বা অ্যাংজাইটি বেড়ে যাওয়ার আরেকটা কারণ বাড়ির পরিসরেও নিহিত থাকে বলে মত সোহিনীর। তাঁর কথায়, ‘বাড়ি থেকে অনেক মহিলাই পর্যাপ্ত সাপোর্ট পান না। তাই কর্মক্ষেত্রে গিয়ে ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না বহু ওয়ার্কিও উম্যান। অফিস একজন কর্মীর থেকে পারফরম্যান্স চায়। ফলে পারফরম্যান্স খারাপ হলে স্বাভাবিকভাবে মানসিক চাপের শিকার হতে হয় মহিলাটিকে। সময় আধুনিক হলেও প্রায়ই দেখা যায়, একটু দেরি করলে ফিরলেই বাড়িতে নানারকম প্রশ্নের শিকার হতে হয়। প্রশ্নটা যে শুধু স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়ি করেন তা নয়, বাবা-মাও করে থাকেন।’
বয়সের নিরিখেও পাল্টে যায় উদ্বেগ
বয়সের নিরিখেও কিন্ত অ্যাংজাইটি বা উদ্বেগের ধরন পাল্টে যায়। সোহিনীর মতো, ‘মেনোপজ হওয়ার আগে কম বয়সী মহিলাদের মধ্যে একধরনের উদ্বেগ দেখা যায়। আবার মেনোপজ হওয়ার পরে আরেক ধরনের উদ্বেগজনিত সমস্যা দেখা যায়।’

মেনোপজ হওয়ার আগে পর্যন্ত
‘কম বয়সী মহিলাদের পিরিয়ডস শুরু হওয়ার বয়স থেকে মেনোপজ হওয়া পর্যন্ত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে এই মেনস্ট্রুয়াল সাইকেল নিয়ে। পিরিয়ডসের সময় ৪-৫ দিন অনেকেই প্রচণ্ড ব্যথার জন্য চলাফেরা করতে রীতিমতো কষ্টবোধ করেন। এই সময় কর্মক্ষেত্রে তাদের পারফরম্যান্সেও প্রভাব পড়ে। খুব কম অফিসেই এখনও পর্যন্ত মেনস্ট্রুয়াল লিভের সুযোগ পান মহিলারা। ফলে স্ট্রেসের শিকার হতেই হয়। অন্যদিকে মা হওয়ার বয়সও এইটা। মা হওয়ার জন্য যে লিভের প্রয়োজন, তা এখনও সব সংস্থা দেয় না। ফলে অনেক মহিলাকে বাধ্য হয়ে কাজ ছাড়তে হয়। আবার অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, মা হওয়ার কথা লুকিয়েও যেতে হয় অনেককে। কারণ সদ্যজাতের প্রতি মায়েদের অনেকরকম দায়িত্ব থাকে। সেই দায়িত্ব সামলে ভালো পারফরম্যান্স করা সম্ভব নয় বলে মনে করে বহু সংস্থা। এরপর এক সময় আসে মেনোপজ। মেনোপজ ও প্রিমেনোপজ ফেজেও বহু শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনেককে সেই অবস্থাতেই কাজ করে যেতে হয়। ফলে উদ্বেগ বা অ্যাংজাইটির শিকার হওয়া স্বাভাবিক।’
বার্ধক্য আসার সময়
আবার মেনোপজের পরেও নানা সমস্যা দেখা দেয়। সোহিনীর কথায়, ‘বার্ধক্যজনিত সমস্যা এক্ষেত্রে অন্যতম। এছাড়াও, ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে তাদের বাইরে চলে যাওয়া এম্পটিনেস সিনড্রোমের মতো সমস্যা তৈরি করে। যেগুলো সামাল দিয়ে কাজের জায়গায় পারফরম্যান্স ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে।’
সমস্যার সুরাহা যে পথে
বিভিন্ন ধরনের ওয়ার্কপ্লেস অ্যাংজাইটির পাশাপাশি এর সুরাহ দিকগুলি নিয়েও আলোচনা করলেন মনোবিদ সোহিনী—
নিয়মমাফিক কিছু ভালো অভ্যাস -রুটিন মেনে যেমন নানা কাজ করতে হয় রোজ, তেমনই কিছু ভালো অভ্যাস রোজকার জীবনে রাখলে অ্যাংজাইটি বা স্ট্রেস অনেকটাই কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
- সাত-আট ঘন্টার ঘুম -অ্যাংজাইটি নিয়ন্ত্রণে রাখার একটি ভালো উপায় নিয়মিত সাত-আট ঘন্টা ভালো করে ঘুমোনো। তাই দিনের শেষে যাতে ঘুমটা ভালো হয়, সেদিকে নজর রাখুন।
- শরীরচর্চা -শরীরচর্চা নিয়মিত করলে মানসিক স্বাস্থ্য একদিকে যেমন ভালো থাকে, তেমনই অন্যদিকে কমে অ্যাংজাইটির মতো সমস্যা। তাই সকালে আধঘন্টা এই কাজে দেওয়া গেলে স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
- বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা -মহিলাদের অনেকেই একটা বয়সের পর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশা করা বন্ধ করে দেন। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, সমস্যার কথা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে দিয়ে অ্যাংজাইটি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তাই সামাজিক জীবনটা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আবার অনেকেই এমন রয়েছেন, যারা সোশ্যালাইজ হতে অপারগ। সেক্ষেত্রে তাঁকে প্রথমে দেখতে হবে ঠিক কী কারণে তিনি সোশ্যালাইজ হতে পারছেন না। সেই সমস্যার সমাধান করা প্রথমে বাঞ্ছনীয়।
মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া -অনেক ক্ষেত্রেই অ্যাংজাইটির জেরে গুরুতর শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এমনটা হলে মনোবিদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি বলে জানালেন সোহিনী। পাশাপাশি জানালেন, নিয়মিত কাউন্সেলিং করালে এই সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ফিরে আসা যায় স্বাভাবিক জীবনস্রোতে।
পাঠকদের প্রতি: প্রতিবেদনটি চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাঁর মতামতের ভিত্তিতে লেখা হয়েছে। এটি সমস্যাটি সম্পর্কে সাধারণ ধারণার উপর আলোকপাত করা মাত্র। ব্যক্তিবিশেষে প্রতিটি সমস্যার চিকিৎসা এবং নিরাময়ের পদ্ধতি পৃথক। তাই যে কোনও সমস্যায় শুধুমাত্র এই প্রতিবেদনের কথায় ভরসা না রেখে, ব্যক্তিগতভাবে চিকিৎসকের বা বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।